ভারতবর্ষের মানুষের তো বারো মাসে তেরো পার্বণ । আর সেই পার্বণের একটি হলো রথযাত্রা অর্থাৎ জগন্নাথ দেবের পুজো। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হলেও ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরীর রথ যাত্রা সব চেয়ে জনপ্রিয়। এই রথ যাত্রা ঘিরে রয়েছে নানা রকম লোক কথা।
আষাঢ় মাসে শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। হিন্দু ধর্মের এক অন্যতম উৎসব। পুরীর রথযাত্রা নিয়ে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসব বিশেষ ভাবে পালিত হয়। রথ কথার আভিধানিক অর্থ যুদ্ধ যান বা যেকোনো ধরনের যানবাহন। কিন্তু হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে রথ কথার অর্থ কাঠের তৈরি একধরনের যানবাহন যাতে করে ভগবান অর্থাৎ ঈশ্বর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করেন।
পৌরাণিক কাহিনীতে রথের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। প্রাচীন মহাভারতে কুরুক্ষেত্র – এর যুদ্ধে রথের ব্যবহার করার কথা উল্লেখ আছে। এই রথ নিয়েই আছে নানা ইতিহাস আর এই ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত আছে শ্রীকৃষ্ণ এর নাম। বলে রাখা ভালো জগন্নাথ দেব এই শ্রীকৃষ্ণ বা নারায়ণেরই এক ভিন্ন রূপ। এইবার জেনে নেওয়া যাক জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব সম্পর্কে।
আরও পড়ুন: Happy Father’s Day 2021 in Bengali
Table of Contents
জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব কিভাবে হয়েছিল
কথিত আছে মানবরাজ ইন্দ্রদুন্ম ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের উপাসক। তিনি অনেক টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন একটি উপাসনা কেন্দ্র। কিন্তু সেই উপাসনা কেন্দ্রে ছিল না কোনো বিগ্রহ। রাজা পড়লেন বিপদে। সেই সময় জঙ্গলে খুঁজতে যাওয়া হলো বিষ্ণুর মূর্তি। কিন্তু তাকে জঙ্গলে খুঁজে পাওয়া গেলো না। উল্টে বিদ্যাপতি জঙ্গলে হারিয়ে গেলেন। বিদ্যাপতিকে উদ্ধার করলেন শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা।
সময়ের গতিতে তাদের পরিণয় ঘটলে বিদ্যাপতি লক্ষ্য করেন তার শশুরমশাই রোজ কোথাও একটা যান। জিজ্ঞেস করে জানা যায় তিনি দূরের কোনো এক পর্বতে যান বিষ্ণু দেবের পূজা করতে। সেখানে আছে বিষ্ণুদেবের বিগ্রহ। এমন সময় স্বয়ং বিষ্ণুদেব স্বপ্নে জানায় তিনি মানবরাজ ইন্দ্রদুন্ম- র কাছে পুজো চান। সেই মতো খবর পাঠানো হলে তিনি বনে এসে দেখেন মূর্তি নেই।
এরপরে স্বয়ং ভগবান রাজাকে স্বপ্নে এসে বাণী দেন যে সমুদ্রে ভেসে আসা কাঠ দিয়ে তৈরি হবে তার মূর্তি। সে কাঠ ভেসে এলে দেখা যায় সে কাঠ এতই শক্ত যে তা কোনো ভাবেই কাটা যায় না। এমনই সময় একজন বৃদ্ধ শিল্পী সে এসে রাজা কে বলেন সে মূর্তি তৈরি করে দেবেন কিন্তু যতদিন তিনি মূর্তি বানাবেন সেখানে কেউ যেতেও পারবে না এবং দেখতেও পারবে না।
এমনই একদিন রাজা কৌতূহল বসত সেই ঘরে ঢুকে দেখেন সেই বৃদ্ধ ও উধাও এবং মূর্তি ও অসম্পূর্ণ এবং অদ্ভুত কদাকার। এমতাবস্থায় ভগবান রাজাকে স্বপ্নাদেশ দেন এই রূপেই তাকে পুজো করতে হবে। আর তখনই শুরু হয় জগন্নাথ দেবের পুজো। আর এই রহস্যময় শিল্পী ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা।
আরও পড়ুন: বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২১, থিম, স্লোগান
পুরীর মন্দিরের ইতিহাস
জগন্নাথ দেবের মূর্তির মতোই পুরীর মন্দিরও বেশ রহস্যজনক। রাজা ইন্দ্রদুন্ম স্বপ্নাদেশ পালন করে মন্দির তৈরির পর দ্বাদশ শতকে গঙ্গারাজবংশের রাজা অনন্তবর্মন পুনরায় মন্দিরের কাজ শুরু করেন।
এই মন্দির হিন্দুদের কাছে এক পবিত্র স্থান। প্রায় দশ একর জমিতে বিশফুট প্রাচীর দ্বারা নির্মিত এই বিশাল মন্দিরের চারটি প্রবেশদ্বার। মন্দিরে নিয়মিত সকালে কিছু নিয়মবিধি মেনে কিশোর ছেলেরা প্রায় ৬৫ মিটার উঁচু চূড়ায় উঠে পতাকা লাগায়, একে পুরীতে ধ্বজা বলা হয়। এই পতাকা হাওয়ার বিপরীতে ওরে। বলা হয় এই পতাকা মন্দির কে সব রকম বিপদ থেকে রক্ষা করে।
এছাড়াও বলা হয় পুরীর মন্দির সমুদ্রের খুব কাছে হলেও মন্দিরে প্রবেশ করা মাত্রই সমুদ্রের কোনো আওয়াজ মন্দিরের ভিতর পাওয়া যায় না। এর কারণ হিসাবে সেবায়েত ও পুরোহিতরা বলেন পুরীর মন্দির শান্তির প্রতীক তাই এখানে সবসময় শান্তি বিরাজমান।
পুরীর রথ দেখতে প্রতি বছর প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। কথিত আছে পুরীর রথের দড়ি ছুঁলে তার আর পুনর্জন্ম হয় না।
আরও পড়ুন: পেটের মেদ কমানোর সেরা ১৫ টি উপায়
রথ তৈরির উপকথা
উড়িষ্যার প্রাচীন পুঁথি ব্রহ্মান্ড পুরাণে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। ইন্দ্রদুন্ম – এর হাত ধরেই এই রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল। এই রথ তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। মোট তিনটি রথ বানানো হয়।
এই রথ তৈরির কাঠ আনা হয় পুরীর কাছেই দুটি জঙ্গল – দাসপাল্লা ও রানাপুর নামে দুটি জঙ্গল থেকে।একটি বলরামের, একটি সুভদ্রার এবং অন্যটি জগন্নাথ দেবের। বলরামের রথে ১৬ টি চাকা থাকে, সুভদ্রা রথে ১৪ এবং জগন্নাথ দেবের রথের ১৮ টি চাকা থাকে।
প্রতিটি রথের আলাদা আলাদা নাম আছে জগন্নাথ দেবের রথের নাম নন্দী ঘোষ, বলরামের রথের নাম তলধ্বজ আর সুভদ্রার রথের নাম পদ্মধ্বজা।
জগন্নাথ দেবের মূর্তি সাজানো থাকে প্রায় ২০৮ কেজি সোনা দিয়ে। প্রতি বছর নতুন রথ তৈরি করা হয় আর প্রতিটি রথে থাকে চারটি করে ঘোড়া। প্রতিটি রথের উপরিভাগ হয় লাল রঙের।
আরও পড়ুন: ১৩ সংখ্যাকে কেন Unlucky বলা হয়
রথযাত্রার সম্পর্কে পৌরাণিক কথা
এইবার আসি রথযাত্রা প্রসঙ্গে। প্রতি বছর তিনটে রথ সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে গণ্ডিচা মন্দিরে যায় এই রথ। অর্থাৎ মাসির বাড়ি। কথিত আছে রাজা ইন্দ্রদুন্ম- র স্ত্রী ছিলেন তিনি। যদিও এই মতের সত্যতা নিয়ে দ্বিমত আছে। আবার সাতদিন পরে মাসির বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে জগন্নাথ দেব সহ বলরাম ও সুভদ্রার রথ। যাকে আমরা উল্টো রথ বলে জানি।
বর্তমানে রথের যাত্রা পথ একটি হলেও আনুমানিক ৭০০ বছর পূর্বে এই যাত্রাপথ দুভাগে বিভক্ত ছিল। কারণ মন্দির থেকে গণ্ডিচা আসার রাস্তায় ছিল একটি নালা। যার নাম বলাগুলি নালা। তাই সেই নালার পারে রথ এলে রথ থেকে বিগ্রহ নামিয়ে তা নালা পার করে ওপর পাড়ে রথে তোলা হত। এর জন্য তৈরি হতো মোট ছয়টি রথ। পরে রাজা কেশরী নরসিংহ সেই নালা বুজিয়ে দিলে রথের যাত্রা একটি পথেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেই থেকেই পুরিতে তিনটি রথ।
রথযাত্রার ১৫ দিন আগে অনুষ্ঠিত হয় স্নান যাত্রা। প্রতিবছর অক্ষয়তৃতীয়ার দিন জগন্নাথ দেব অসহ্য মাথার যন্ত্রনায় কাহিল হয়ে পড়েন তখন তার মাথায় দেওয়া হয় চন্দনের প্রলেপ। আর সেই প্রলেপ তুলতেই ভগবানকে স্নান করানো হয় দুধ এবং নানারকম সুগন্ধি আতর ও শীতল জল দিয়ে। এরপরেই শ্রী দেবের জ্বর আসে। তাই স্নান যাত্রার পরের ১৫ দিন ভগবান কে দর্শন করা যায় না।
আরও পড়ুন: শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ১৩ টি সহজ উপায়
রথযাত্রা কিভাবে Celebrate করা হয়
এই রথযাত্রা মূলত ওড়িশা সহ পশ্চিমবঙ্গের উৎসব হলেও এতে সারা পৃথিবীর নানা ধর্মের বহু মানুষের সমাগম ঘটে। সবার একবার রথের দড়ি টানার ইচ্ছা হয় এবং দড়ি টানার জন্য প্রচুর মানুষের ভিড় জমে যায় রথের চারধারে।
রথযাত্রার উপলক্ষে বহু জায়গায় ১০দিন বা ১৫ দিনের জন্য বিশাল মেলার আয়োজন হয়, যাকে আমরা রথের মেলা বলে সম্মোধন করি। দোকানীরা বিভিন্ন্য প্রসাধন সামগ্রী, হরেকরকম বাচ্ছাদের খেলনা, ঘর সাজানোর সামগ্রী, জামাকাপড় ইত্যাদির দোকান করে তা বিক্রি করেন। তাই মেলায় প্রচুর মানুষের সমাগম হয়।
কথিত আছে এই দিন নাকি পাঁপড় ভাজা খেতে হয়, তাতে মঙ্গল হয়। তাই বহু দোকানে পাঁপড় ভাজা বিক্রি করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন্য মিস্টি জাতীয় খাবার যেমন জিলাপী, গজা ইত্যাদি খাওয়ার একটা হিড়িক পরে যায়।
পশ্চিমবঙ্গের রথযাত্রার কথা
ভারতবর্ষের উড়িষ্যা সহ পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় এই রথ উৎসব পালিত হয়। এখানে শ্রীরামপুরের মহেশের রথযাত্রা সবচেয়ে বিখ্যাত। এছাড়াও কলকাতার ইস্কন এর রথযাত্রা এবং শান্তিপুরের রথযাত্রার অনেক সুখ্যাতি আছে। এই সব জায়গাতেই রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা বসে।