কালীকথা: জানুন বঙ্গের লোকপ্রিয় কালীমন্দির ও শক্তিপীঠের কথা ও ইতিহাস

সামনেই কালীপূজা অর্থাৎ দীপাবলি-আমাদের আলোর উৎসব। মাতৃরুপের দেবীদূর্গার প্রস্থানের পর‌ই ভয়লেশহীন দেবী ফিরে আসেন কালীরুপে। শাস্ত্র অনুসারে, মা ভগবতী দুষ্টের অবসান ঘটাতে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিলেন, যিনি মা কালী নামে পরিচিত। এই পূজা করলে মানুষের সমস্ত ভয় দূর হয়। তার রুপ যত‌ই স্নিগ্ধতাবিহীন হোক না কেন তিনি তো আদতে মা-ই – করুণাময়ী মা । আর সেই জন্যেই কলকাতা তথা বঙ্গের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে বহু কালীমন্দির

লোকপ্রিয় কালীমন্দির ও শক্তিপীঠের কথা ও ইতিহাস

মা কালী হলেন মা দুর্গার রূপময় রূপ এবং এটা সকলের জানা যে মা দুষ্টদের বধ করার জন্যই এই রূপ ধারণ করেছিলেন। শাস্ত্রে মায়ের এই রূপ পরিধানের পিছনে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে আর আজকের প্রতিবেদনে আমরা সেই কালীকথাই জানতে চলেছি।

দক্ষিনেশ্বরের  মা ভবতারিনীর মন্দির

কলকাতা তথা গোটা রাজ্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় মন্দির হল দক্ষিনেশ্বর। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম ঘটে। এখানে মা ভবতারিণী রূপে বিরাজমান। জনপ্রিয় অভিনেতা থেকে শুরু করে নেতা মন্ত্রী-কে না আসেন এখানে পুজো দিতে, তাদের মন মনস্কামনা পূরণ করতে। এই মন্দির শুধু গরিব মানুষ থেকে বড়লোকদের জন্যই নয়, এখানে সব ধর্মের মানুষের, সব ধরনের মানুষের অবাধ যাতায়াত।   

প্রতিষ্ঠা: ১৮৪৭-তে করুণাময়ী রানি রাসমণি এই মন্দির নির্মাণ শুরু করেছিলেন এবং মন্দিরের কাজ শেষ হয় ১৮৫৫ সালে।

ইতিহাস: দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির আক্ষরিক অর্থেই রানি রাসমণির স্বপ্নের মন্দির। জানবাজারের রানির কথায়, কাশী যাওয়ার পথে স্বয়ং দেবী কালী তাঁকে স্বপ্নে এই মন্দির তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন।

১০০ ফুটেরও বেশি উঁচু এই নবরত্ন মন্দির। এর স্থাপত্য দেখার মতো। গর্ভগৃহে সহস্র পাপড়ির রৌপ্য-পদ্মের উপর শায়িত শিবের বুকে দেবী কালী দাঁড়িয়ে। এক খণ্ড কষ্ঠিপাথর খোদাই করে তৈরি হয়েছে এই দেবীমূর্তি। 

আরো পড়ুন:  Mahavir Jayanti 2023: জানুন মহাবীর জয়ন্তীর তারিখ, শুভ সময়, উৎসবের গুরুত্ব এবং ভগবান মহাবীরের চিন্তাভাবনা

খরচ: এই মন্দির তৈরি করতে তখনকার দিনে খরচ হয়েছিল ৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন: 2021 দীপাবলিতে হাতেখড়ি করুন নতুন ব্যবসায়, জানুন একঝাঁক নতুন আইডিয়া

আদ্যাপীঠ মন্দির

দক্ষিনেশ্বরী কালীমন্দিরের প্রায় কাছাকাছি কলকাতার উত্তর প্রান্তে শক্তি আরাধনার অন্যতম পীঠস্থান হল আদ্যাপীঠের মন্দির। এখানে মা আদ্যামা রূপে বিরাজ করেন।

প্রতিষ্ঠা: ১৩৪০ বঙ্গাব্দে মন্দির নির্মাণ শুরু করেন অন্নদাঠাকুর। ১৩৭৫ সনের মকর সংক্রান্তিতে শেষ হয় শ্রী অন্নদা ঠাকুরের স্বপ্নে দেখা মন্দিরের নির্মাণ।

ইতিহাস: আদতে হাসপাতাল গড়ে তোলার ইচ্ছা ছিল অন্নদা ঠাকুরের। একদিন স্বপ্নে রামকৃষ্ণদেব তাকে বলেন, ইডেন জলাশয় থেকে মাতৃমূর্তি তুলে এনে মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। তার পরই স্বপ্নাদেশ মেনে ইডেন জলাশয়ে একটি মাত্র ডুব দিয়েই হাতে আসে কালীরত্নধন। সেই মূর্তি তুলে এনে প্রতিষ্ঠা হয় আদ্যাপীঠ মন্দির।

তিন চুড়োওয়ালা ৩ ধাপের মন্দির এই আদ্যাপীঠ। প্রথম ধাপে শ্রীরামকৃষ্ণ, মাঝের ধাপে আদ্যামা এবং সব নিচের ধাপে রাধাকৃষ্ণ। তবে মূল মন্দিরে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। নিয়ম অনুযায়ী দীপান্বিতা অমাবস্যা শুরু হলে তবেই পুজো হয়।

আরও পড়ুন: 40 বছরের পরেও কীভাবে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণ করবেন

কালীঘাট মন্দির 

কলকাতার একটি প্রসিদ্ধ কালীমন্দির এবং একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থের পীঠদেবী দক্ষিণাকালী এবং ভৈরব বা পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর রূপে পূজিত হন।

প্রতিষ্ঠা: ১৮০৯ সালে বড়িশার সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তের উদ্যোগে আদিগঙ্গার তীরে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। 

ইতিহাস: কথিত আছে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের চারটি (মতান্তরে একটি) আঙুল এই তীর্থে পড়েছিল। পুরাণ মতে এ স্থান বারাণসী তুল্য।

আরো পড়ুন:  Ganesh Chaturthi 2023: জানুন গনেশ চতুর্থী তিথি, পূজোর বিধি, নিয়ম, মন্ত্র, উপকরণ এবং ইহার তাৎপর্য

এই মন্দিরটি নব্বই ফুট উঁচু। মন্দিরের উপরে রয়েছে ৩ টি কলস, ১ টি ত্রিশূল ও ১ টি ত্রিকোণা ধাতব পতাকা যাতে ‘ॐ’ লিখিত। এটি নির্মাণ করতে আট বছর সময় লেগেছিল।

খরচ: মন্দির নির্মাণে সেইসময় ব্যয় হয়েছিল ৩০,০০০ টাকা।

আরও পড়ুন: সূর্য নমস্কার: এই ৫ টি সূর্য নমস্কার আসন করলে পাবেন চমৎকার ফল

ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি

দক্ষিণেশ্বর, আদ্যাপীঠের মতোই উত্তর কলকাতার আরও একটি প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন মন্দির হল ঠনঠনিয়া কালীমন্দির। এখানে মা রটন্তী কালী রূপে বিরাজমান করেন।

প্রতিষ্ঠা: জনশ্রুতি অনুযায়ী ডাকাতরা এই কালীমুর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাধক রামপ্রসাদ আর যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের নাম‌ও।

ইতিহাস: এই মন্দিরের ঘণ্টা বাজিয়েই একসময় ডাকাতরা তাদের হামলার সতর্কবার্তা ছড়িয়ে দিত দূর দূরান্তে। ঘণ্টার ঠনঠন শব্দ থেকে মন্দিরের নাম ঠনঠনিয়া।

আরও পড়ুন: ঘরে বসে মেয়েদের ওজন কমানোর ৬ টি সেরা উপায়

লেক কালীবাড়ি

এখানে মা করুণাময়ী কালী রূপে পূজিত হন। লেককালীবাড়ি অবস্থিত দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্রও সরোবরের ধারে অর্থাৎ ঢাকুরিয়া লেকের ধারে। সার্দান অ্যাভিনিউতে অবস্থিত বিখ্যাত এক কালীমন্দির। 

প্রতিষ্ঠা: ১৯৪৯ সালে হরিপদ চক্রবর্তী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০২ সালে মন্দিরটি সংস্কার শুরু হয়। 

ইতিহাস: মন্দিরটির বয়স বেশী নয়। তবে এটিও স্বপ্নাদেশের ফল। তন্ত্রসাধক হরিপদ চক্রবর্তীকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে মা বলেছিলেন তার পূজা করতে। হরিপদ চক্রবর্তী মানবজাতির শান্তিকামনার স্বার্থে তন্ত্রসাধনা করে একটি ‘পঞ্চমুণ্ডির আসন’ তৈরি করেন। আসনটি পাঁচটি নরমুণ্ড দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। আজ‌ও সেই আসন বিগ্রহের পাশেই অবস্থান করে।

আরও পড়ুন: শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ১৩ টি সহজ উপায়

আরো পড়ুন:  Jagannath Puri Rath Yatra: জগন্নাথ পুরী রথযাত্রা কিভাবে,কেন শুরু হয়েছিল - জানুন কয়েকটি আশ্চর্য কাহিনী

 তারাপীঠ মন্দির 

কলকাতার গন্ডী পেরিয়ে বীরভূমের মাটিতে পা রেখে এবারের পটভূমি তারাপীঠ। দ্বারকা নদীর ধারে রামপুরহাট থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ছোট্ট মন্দিরনগরী। মন্দির সংলগ্ন মহাশ্মশান। এখানে মা মাতারা রূপে বিরাজমান করেন।

প্রতিষ্ঠা: ১৮১৮ সালে রাজা রামজীবন চৌধুরী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। 

রামচন্দ্র চৌধুরী ও মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায় – এনারা একসাথে এই মন্দির নির্মাণ করেন।

ইতিহাস: তারাপীঠ আদতে শক্তিপীঠ। সতীর তৃতীয় নয়ন এই তারাপীঠ গ্রামে পড়ে। কথিত আছে, ঋষি বশিষ্ঠ প্রথম এই রূপটি দেখতে পান এবং সতীকে তারা রূপে পূজা করেন। তারাপীঠ মন্দিরে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা মূর্তিতে দেবী মা তারা পূজিত হয়ে আসছেন।

উত্তরমুখী লাল ইটে নির্মিত আটচালা মন্দিরটির ভিতরের দেওয়াল বেশ মোটা। মন্দিরের প্রবেশপথের মধ্য খিলানেরদুর্গার প্রতিকৃতি রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীমূর্তি সংস্থাপিত। শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা তারার মূল প্রস্তরমূর্তিটি একটি তিন ফুট উঁচু ধাতব মূর্তির মধ্যে রাখা থাকে।

আরও পড়ুন: পেটের মেদ কমানোর সেরা ১৫ টি উপায়

কল্যানেশ্বরী কালীমন্দির

আসানসোলে কাছে অবস্থিত কল্যানেশ্বরী মন্দির জনৈক এবং বহুল প্রচলিত।  

প্রতিষ্ঠা:  লোকশ্রুতি,  এই মন্দিরে কল্যাণেশ্বরী মহাশক্তি পূজা প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো। তবে ঠিক কবে এই মন্দির নির্মিত হয়েছে তার কোনো পাথুরে প্রমাণ মেলেনি কিন্তু শোনা যায়, বর্তমান মন্দিরটি পঞ্চকোট রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে। 

ইতিহাস: এই মন্দিরে প্রথম সিদ্ধিলাভ করেছিলেন কাপালিক দেবীদাস চট্টোপাধ্যায়। শোনা যায়, রাজা বল্লাল সেন ছিলেন এই কাপালিকের ভক্ত। সাধকের নির্দেশ মেনে বল্লাল সেন অধুনা সবনপুরে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে দেবী শ্যামারূপার আরাধনা শুরু হয়। তবে সেখানে জনবসতি বেড়ে যাওয়ায়, আওয়াজ-কলহে বিরক্ত হয়ে শ্যামারূপী কল্যাণেশ্বরী নিরিবিলি গভীর জঙ্গলে এক গর্তে আশ্রয় নেন। তখন থেকেই দেবী ওই জায়গাতেই পূজিতা হচ্ছেন।

আরও পড়ুন: স্বামী বিবেকানন্দের ছেলেবেলার দুটি ঘটনা যা বদলে দেবে আপনার চিন্তাধারা

Share It!

Leave a Comment