ফলহারিণী কালীপূজার মূল তাৎপর্য হল জীবের কর্মফলের বিনাশ এবং মোক্ষ লাভ। হিন্দু শাস্ত্রে বিশ্বাস করা হয় যে, মা কালী জীবের কর্মফল অনুসারে তাদের জীবনে শুভ বা অশুভ ফল দান করেন। এই বিশেষ তিথিতে দেবীর আরাধনা করলে তিনি প্রসন্না হয়ে ভক্তের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-ব্যাধি, বিপদ ও অশুভ শক্তি বিনাশ করেন এবং ঐশ্বর্য, আরোগ্য, বল, পুষ্টি ও গৌরব প্রদান করেন। এটি মানসিক শান্তি, আধ্যাত্মিক প্রগতি এবং কর্মক্ষেত্রে উন্নতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পূজা

এছাড়াও, ফলহারিণী কালীপূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক গভীর আধ্যাত্মিক ইতিহাস। ১৮৭২ সালের (১২৮০ বঙ্গাব্দ) জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর সহধর্মিণী শ্রীমা সারদাদেবীকে দেবী ষোড়শী রূপে পূজা করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। এই ঘটনাটি আধ্যাত্মিক জগতের এক যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই থেকে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে এই পূজা “ষোড়শী পূজা” নামেও পরিচিত। বেলুড় মঠ সহ রামকৃষ্ণ সংঘের বিভিন্ন কেন্দ্রে আজও মহাসমারোহে এই দিনটি উদযাপন করা হয়।পূজার রীতি ও পদ্ধতিফলহারিণী কালীপূজা মূলত রাত্রিকালীন পূজা। জ্যৈষ্ঠ অমাবস্যা তিথিতে এই পূজা নিশিযাপিনী হয়, অর্থাৎ অমাবস্যা পড়লে পূজা শুরু হয় এবং ভোর পর্যন্ত চলে। এই পূজায় বিভিন্ন মরসুমি ফল নিবেদন করা হয়, যেমন – আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, কলা ইত্যাদি। অনেক স্থানে দেবীকে ফলের মালা দিয়ে সাজানো হয়।পূজার পদ্ধতি ও রীতি বিভিন্ন অঞ্চলে ও পরিবারে ভিন্ন হতে পারে, তবে কিছু সাধারণ নিয়মাবলী অনুসরণ করা হয়: * উপবাস: অনেকে এই দিনে উপবাস পালন করেন। * আলোকসজ্জা ও আতসবাজি: কালীপূজার রাতে গৃহ ও মন্দির আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয় এবং আতসবাজি পোড়ানো হয়। * তান্ত্রিক রীতি: মধ্যরাত্রে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। * বলিদান: কিছু কিছু স্থানে তান্ত্রিক মতে বলিদানও করা হয়। * ফল নিবেদন: দেবীকে বিভিন্ন ফল নিবেদন করা হয়। অনেকে ফলের মালা তৈরি করে দেবীকে পরান। * মন্ত্র জপ: ফলহারিণী কালীপূজার দিনে মহাকালীর শক্তিশালী মন্ত্র জপ করা হয়। “ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ” এই মন্ত্রটি ১০৮ বার জপ করা শুভ বলে মনে করা হয়। এছাড়াও, “ধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে” এই মন্ত্রটিও জপ করা হয়। এই মন্ত্রগুলি অজ্ঞানতা ও মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি দেয় বলে বিশ্বাস। * আরাধনা: ভক্তরা সারারাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে কালী প্রতিমা দর্শন করেন। * বিশেষ ব্রত: জ্যোতিষ মতে, এই দিনে একটি বিশেষ মরসুমি ফল দিয়ে দেবীর পূজা করে, সেই ফলটি এক বছর পর্যন্ত ভক্ষণ না করার নিয়ম আছে, যা ব্যক্তিগত সিদ্ধি পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।ভারতবর্ষ জুড়ে ফলহারিণী কালীপূজাপশ্চিমবঙ্গ, অসম, ঝাড়খণ্ড এবং বাংলাদেশে ফলহারিণী কালীপূজা বিশেষভাবে পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের কালীঘাট মন্দির, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি এবং তারাপীঠের মতো প্রসিদ্ধ কালী মন্দিরগুলিতে এই দিনে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। কালীঘাট মন্দিরে এই দিন দেবী কালীকে লক্ষ্মীরূপে পূজা করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত দেবীর আশীর্বাদ লাভের জন্য এই মন্দিরগুলিতে ভিড় করেন। অনেক নারী তাদের সন্তানদের কল্যাণ কামনায় এই দিনে উপবাস রেখে পূজা করেন। যারা কর্মক্ষেত্রে বাধা, প্রেম বা দাম্পত্য জীবনে অশান্তির সম্মুখীন, তারা দেবীর কাছে শান্তি ও সাফল্যের প্রার্থনা করে থাকেন।ফলহারিণী কালীপূজা কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি এক আত্মশুদ্ধির যাত্রা। এটি জীবনের সমস্ত অন্ধকার ও অশুভ শক্তির উপর বিজয় ঘোষণা করে এবং ভক্তদের পরিপূর্ণ আলো ও কল্যাণের পথে চালিত করে।

Share It!
আরো পড়ুন:  পুরুষদের রসুন খাওয়ার প্রধান উপকারিতা I Benefits of Eating Garlic for Men in Bengali

Leave a Comment